বৃহস্পতিবার, ২৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৪:৪৪ অপরাহ্ন

সংবাদ শিরোনাম :
ডেঙ্গু প্রতিরোধ ও আমাদের করণীয়

ডেঙ্গু প্রতিরোধ ও আমাদের করণীয়

একজন কবি তার কবিতায় লিখেছেন, মানুষ তার বিবেককে প্রশ্ন করছে, তুমি কোথায়? উত্তরে বিবেক বলছে, আমি কফিনের শেষ পেরেকের মাথায়। এ কথা শুনে প্রশ্নকর্তা আবার জিজ্ঞেস করলেন, ওখানে কেন? অদৃশ্য থেকে উত্তর ভেসে এলো; তুমিই আমাকে ওখানে নিয়ে গেছ।

আমাদের অবস্থাও তাই হয়েছে। ডেঙ্গুর ভয়াবহতা আগে থেকে জেনেও কর্তৃপক্ষ যথাযথ পদক্ষেপ নেয়নি। তার খেসারত হিসেবে মানুষ জীবন দিচ্ছে। দেশের বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে অন্তত শ’খানেক মানুষের মৃত্যু হয়েছে। তবে স্বাস্থ্য অধিদফতর পরিবেশিত সংখ্যাটি এর চেয়ে অনেক কম। দেশের ৬৪টি জেলার মধ্যে ৬৩টি জেলায় ডেঙ্গু ছড়িয়ে পড়েছে। ডেঙ্গু রোগ যে হারে বেড়েছে তার চেয়ে বেশি আতঙ্ক মানুষের মধ্যে বেড়েছে। চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ৩০ জুলাই পর্যন্ত দেশে ডেঙ্গুতে আক্রান্তের সংখ্যা প্রায় ১৫ হাজারে দাঁড়িয়েছে। প্রতি মিনিটে একজন মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হচ্ছে। এর ভয়াবহতার জন্য সবাই কমবেশি দায়ী। এডিস মশা হচ্ছে ডেঙ্গুর জীবাণু বহনকারী প্রাণী। মশার মাধ্যমে এই রোগ ছড়ায়।

সাধারণত এপ্রিল থেকে জুন মাসে ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়তে থাকে। সাধারণ মশার চেয়ে এ মশা আকারে বড় ও গায়ে ডোরা কাটা। এরা পরিষ্কার পানিতে ডিম পাড়ে। ডেঙ্গু প্রতিরোধে সরকারের ভূমিকা খুবই হতাশাজনক। এই সরকার বিরোধী মতাবলম্বীদের দমনে সফল হলেও মশা নিধনে পরাস্ত। অতীতে যারা রাজধানীর ‘নগরপিতা’ ছিলেন, তারাও মশার সাথে লড়াই করে বরাবরই পরাজিত হয়েছেন। মোহাম্মদ হানিফ, মির্জা আব্বাস, সাদেক হোসেন খোকা কেউ মশার সাথে লড়াই করে জিততে পারেননি। তাদের উত্তরসূরিদের অবস্থা আরো নাজুক। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, ‘মশার কাজ মশা করেছে, কামড় দিয়েছে গায়, তাই বলে কি মশা মারা নগরপিতার শোভা পায়!’

কয়েক সপ্তাহ পরেও ডেঙ্গুর প্রকোপ বেড়েই চলেছে। ইতোমধ্যে এ রোগ রাজধানীর সীমানা অতিক্রম করে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ছড়িয়ে গেছে। হঠাৎ করে বাড়েনি! দু’দশক আগে এর সংক্রমণ দেখা দিলেও আমাদের দেশে কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে এর সংক্রমণ ভয়াবহ রূপে জানান দিয়েছে। হাসপাতালগুলো রোগী সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছে। ডেঙ্গুর উৎস আগেই বন্ধ করা উচিত ছিল। কিন্তু দুই সিটি করপোরেশন সে কাজটি করেনি। যদি তারা দায়িত্বপালন করত, তাহলে পরিস্থিতি এতটা ভয়াবহ হতো না। যথাসময়ে পদক্ষেপ নিলে ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি হওয়ার আগেই হয়তো প্রতিরোধ করা সম্ভব হতো। কর্তৃপক্ষ এখন নামকাওয়াস্তে ওষুধ ছিটাচ্ছেন যা কার্যকর নয়।

উচ্চ আদালতও বিষয়টি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। ওষুধ ফলপ্রসূ কি না তা আগে কেন পরীক্ষা করা হয়নি, তা-ও উচ্চ আদালত জানতে চেয়েছেন। বিশ^ স্বাস্থ্যসংস্থা যেখানে ডেঙ্গু পরিস্থিতিকে উদ্বেগজনক বলে জানিয়েছেন, সেখানে বাংলাদেশ সরকারের দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা ডেঙ্গু নিয়ে নানা কাণ্ডজ্ঞানহীনের মতো কথা বলছেন, যা আগুনে ঘি ঢালার শামিল। ঢাকা সিটি করপোরেশন দক্ষিণের বাচাল মেয়র ডেঙ্গু নিয়ে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন কথা বলছেন। একবার বলেছেন, মশা অনেক শক্তিশালী। এ কারণেই মশা মারার ওষুধে কাজ হচ্ছে না’ বলেছেন, ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা নিয়ে ছেলেধরার গুজবের মতোই গুজব ছড়ানো হচ্ছে। আরেক নগরপিতা বলেছেন, তার এলাকায় মশা নেই, মশা পাশের এলাকা থেকে চলে আসছে। স্বাস্থ্যমন্ত্রী তো আরো ভয়ঙ্কর মন্তব্য করেছেন।

তিনি বলেছেন, ডেঙ্গুর বাহক এডিস মশার প্রজনন রোহিঙ্গাদের মতোই। একজন নগরপিতা কিংবা রাষ্ট্রের দায়িত্বশীল ব্যক্তির কাছ থেকে এহেন দায়িত্বহীন বক্তব্য জাতির জন্য লজ্জাকর। তবে কেউ কেউ বলছেন, ওষুধ কেনার মহা দুর্নীতি আর অদক্ষতা ঢাকতেই ডেঙ্গুর ভয়াবহতার খবরকে গুজব বলা হয়েছে। রাজধানীতে ডেঙ্গুর ভয়াবহতা নগরপিতারা স্বীকার না করলেও অর্থমন্ত্রী মুস্তফা কামাল ডেঙ্গু জ্বর নিয়ে হাসি-ঠাট্টা বা কোনো অবহেলা না করে সবাইকে সচেতন হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। কারণ, তিনি নিজেই দু’দফায় ডেঙ্গু জ্বরের ভুক্তভোগী।

বাংলাদেশে সর্বপ্রথম ১৯৯৮ সালে ডেঙ্গু রোগী পাওয়া গিয়েছিল। তবে স্বাস্থ্য অধিদফতর ডেঙ্গু রোগীর হিসাব ২০০০ সাল থেকে শুরু করে। তাদের হিসাব মতে, ওই বছর থেকে চলতি বছর পর্যন্ত সারা দেশে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছে ৫৯ হাজার ৮৩৩ জন এবং মৃত্যু হয়েছে ৩০৪ জনের। ২০০০ সালেই ৯৩ জনের মৃত্যু হয়। এরপর মৃতের সংখ্যায় হ্রাস-বৃদ্ধি ঘটেছে। অধিদফতরের পুরোনো হিসাবে দেখা গেছে, ২০১৮ সালে ১০ হাজারের বেশি মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হন এবং ২৬ জনের মৃত্যু হয়। জনগণকে বাড়তি সেবা দেয়ার জন্য কয়েক বছর আগে ঢাকা সিটি করপোরেশন ভেঙে দুটো করপোরেশন করা হয়েছে। তাদের রয়েছে বিশাল অফিস। আছে শত শত কর্মীবাহিনীও। গত বছর ডেঙ্গু আর চিকুনগুনিয়ার প্রাদুর্ভাবের সময় ঢাকা দক্ষিণের মেয়রকে বলতে শুনেছি, আগামী বছর ডেঙ্গু পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পারব।’ কিন্তু দুঃখজক হলেও সত্য, গত বছরের চেয়ে এবারের পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ। এই দায় নগরপিতারা কিছুতেই এড়াতে পারেন না।

বিশ^ স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, বিশ^ জনসংখ্যার পাঁচ ভাগের দুই ভাগ, অর্থাৎ ২৫০ কোটি মানুষ ডেঙ্গুর ঝুঁকিতে বসবাস করছে। এর ৭০ ভাগ এশীয় ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের দেশগুলোতে বাস করে। বাংলাদেশও এর অন্তর্ভুক্ত। বিশ^ব্যাপী কোটি কোটি মানুষের মধ্যে ডেঙ্গু, জিকা ডাইপস ও চিকুনগুনিয়াসহ বিপজ্জনক নানা রোগের সংক্রমণ ঘটাচ্ছে এডিস প্রজাতির মশা। এই কীটের যন্ত্রণায় বাংলাদেশের মানুষও অতিষ্ঠ। হাসপাতালে জায়গা পাচ্ছে না রোগীরা। মশা নিয়ন্ত্রণের কাজটাও ঠিকমতো হচ্ছে না। এ নিয়ে সরকারের বিরুদ্ধে হাজারো অভিযোগ। ওষুধের মান ও কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। নতুন ওষুধ আনার নাকি উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। কিন্তু সমস্যা হলো, নতুন ওষুধ আসতে আসতে হয়তো এবারের ডেঙ্গু মওসুমই শেষ হয়ে যাবে। অথচ প্রতিদিন ডেঙ্গুতে মানুষ মারা যাচ্ছে। আমাদের দেশে কীটনাশক তথা রাসায়নিক দ্রব্য দিয়ে মশা নিধন করা হয়। কিন্তু চীনের বিজ্ঞানীরা মশা নিধন করছেন ভিন্ন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে।

মাত্র দুই বছরে চীনের শহর গুয়াংঝুর দুটি দ্বীপপুঞ্জ থেকে এডিস মশা প্রায় ধ্বংস করতে সক্ষম হয়েছেন দেশটির বিজ্ঞানীরা। এক গবেষণা প্রবন্ধে ওই সাফল্যের কথা ‘দ্য ন্যাচার’ জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, দুই স্তরের পদ্ধতিতে মশা নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করা হয়। এক. বিকিরণের মাধ্যমে মশাকে নির্গত করা হয়। দুই. ওলবাখিয়া প্রজাতির ব্যাকটেরিয়ার মাধ্যমে ডিম থেকে মশার উৎপাদন রোধ করা হয়। চীনে এখন কীটনাশকের পরির্বতে মশা দিয়ে মশার বিস্তার রোধ করা হচ্ছে।

প্রত্যেক সরকারের আমলেই স্বাস্থ্য সচেতনতা সম্পর্কে অনেক পদক্ষেপের কথা আমরা শুনি। কিন্তু এর ছিটেফোঁটাও বাস্তবায়ন হয় না। ডেঙ্গু প্রতিরোধে জনসচেতনতা হচ্ছে সবচেয়ে বড় হাতিয়ার। বিশেষ করে বৃষ্টির পানিতে বাড়ির আশপাশে জলাশয়ে, ডোবা-নালায়, ডাস্টবিনে, ঝোপ-জঙ্গলে যেন মশা-মাছি জন্মাতে না পারে, সে বিষয়ে দৃষ্টি দেয়া প্রয়োজন। রাত ও দিনের বেলায় মশারি টানিয়ে ঘুমানো, জানালায় নেট ব্যবহার করা, প্রয়োজন ছাড়া দরজা-জানালা খোলা না রাখা এবং বাসার আশপাশে ফেলে দেয়া মাটির পাত্র, কলসি, বালতি, ড্রাম, ডাবের খোসায় পানি জমতে না দেয়া জরুরি। জমে থাকা পানিতেই এডিস মশা বাড়তে পারে। প্রতিষেধকের চেয়ে প্রতিরোধই উত্তম। সরকারের সদিচ্ছা থাকলে ডেঙ্গু প্রতিরোধে কার্যকর ভূমিকা পালন করা সম্ভব। আমাদের দেশে অনেক সেবামূলক প্রতিষ্ঠান রয়েছে, যদি তাদের জনসচেতনতা বৃদ্ধির পাশাপাশি পরিচ্ছন্নতার কাজে লাগানো যায়, তাহলে ডেঙ্গুর উপদ্রব থেকে দেশবাসীকে রক্ষা করা সম্ভব।

দয়া করে নিউজটি শেয়ার করুন..

© All rights reserved © 2019 shawdeshnews.Com
Design & Developed BY ThemesBazar.Com
themebashawdesh4547877